হতাশা ছাপিয়ে সম্ভবনা




১৯৯৪ সালের কথা। হলিউডে হৈচৈ ফেলে Shawank Redemption নামে একটি মুভি মুক্তি পায়। মুভিটি এতই জনপ্রিয় যে দুই দশক পরেও এটি আমাদের পছন্দের মুভিগুলোর একটি। মুভিটিতে পরিচালক Frank Darabont এক অনবদ্য কাহিনীর মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন কিভাবে একজন কয়েদী তার কারাবন্দী দুঃসহ জীবন থেকে শুধুমাত্র Hope কে আঁকড়ে ধরে শেষ পর্যন্ত মুক্ত পৃথিবীর আলো দেখেছে। মুভিটির বিখ্যাত একটি উক্তি আছে, "HOPE IS A GOOD THING, MAY BE THE BEST OF THINGS AND NO GOOD THINGS EVER DIES." 

লিখছি Hope নিয়ে- করোনাভাইরাসে চাপা আশা-ভরসা নিয়ে।

অন্যান্য বছরের মতো ২০২০ এসেছিলো নতুন উদ্যমে, আরো  নতুন আঙ্গিকে। স্বভাবতই আমাদের পরিকল্পনায় ছিলো নতুন নতুন কাজের তালিকা। মাসগুলো গড়িয়ে চলার সাথে আমরাও তালে তাল মিলিয়ে চলতে শুরু করি। কে জানত বাঁধা পড়বে? হঠাৎ করেই ভেঙ্গে পড়বে আমাদের চারপাশটা? নতুন কিছু অর্জনের বিপরীতে হারাতে হবে পুরনো কিছু- প্রিয়জন, জীবিকা, সম্পর্ক কত কি! হারানোর পাল্লা যত ভারী হচ্ছে, তত চোখের সামনে ছোট হয়ে আসছে  চেনা পৃথিবীটা। 


লিখছি একটা দুর্বল ভাইরাসকে নিয়ে যা যতটা না ভয়ঙ্কর, তা তারচেয়েও বেশি অতিরঞ্জিত করে আমাদের দেখানো হচ্ছে। যে কোন আলোচিত বিষয়কে ঘিরেই জল্পনা- কল্পনা কিংবা মনগড়া তথ্য থাকাটা স্বাভাবিক। আমাদের দেশেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো থেকে শুরু করে মানুষের মুখেমুখে এসব মনগড়া তথ্য ঢালাও ভাবে প্রচার করা হচ্ছে।


সবচেয়ে দুঃখের বিষয় কেউ কেউ এইসব মনগড়া গুজবে বিশ্বাসও করছে। তন্মধ্যে কিছু গুজব  মানুষের মনে অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। যেমনঃ কোন ভ্যাকসিন আসার কোন সম্ভাবনা নেই, পৃথিবী হয়ত এভাবেই চলবে, আর যদি কোন ভ্যাকসিন আসেও বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশে সবাই তা হয়তো পাবেনা। এ মনগড়া অভিমতগুলোর বিষয়ে এক বাক্যে বললে, “ These are quite mythical and unrealistic opinions and we still have more reasons to be optimist than no to be.”

 
এক্ষেত্রে আশাবাদী হওয়ার মতো কারণতো অবশ্যই রয়েছে। চলুন সেগুলো দেখে আসা যাকঃ

• যেখানে স্প্যানিশ ফ্লু তে সারা বিশ্বে আক্রান্তের বিপরীতে মৃতের সংখ্যা ছিলো ১০ শতাংশের বেশি (Source:The Los angles ttimes)। ইবোলা ভাইরাসকে এই তুলনায় রাখা যাবেনা কারণ এটি এতই মারাত্মক ছিলো যে আক্রান্তের বিপরীতে মৃতের সংখ্যা ছিলো প্রায় ৫০ শতাংশ। ভাবা যায়? সেখানে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের হার তুলনামূলক বেশি হলেও আক্রান্তের স্বাপেক্ষে মৃতের হার প্রায় ৫ শতাংশ (আমাদের দেশে তা মাত্র ১.৫৭ শতাংশ) এবং আক্রান্ত রোগীর সুস্থতার হার প্রায় ৫০ শতাংশেরও বেশি। 
এবার আপনিই ভাবুন, স্প্যানিশ ফ্লু কিংবা ইবোলার মতো ভয়ংকর ভাইরাস থেকেও যদি পৃথিবী উদ্ধার পেতে পারে, সেখানে করোনা ভাইরাস থেকে যাবে?


• একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে, সারা পৃথিবী জুড়ে ভ্যাকসিন নিয়ে যে প্রতিযোগিতা চলছে তাতে দেখা যায় প্রায় ১০০ টির মতো ভ্যাকসিন ক্যান্ডিডেট রয়েছে, যেখানে স্বনামধন্য গবেষকেরা অক্লান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছে। এদের মধ্যে ৩২ টি ভ্যাকসিনে গবেষকরা উল্লেখযোগ্য সফলতা দেখেছে। যেখানে ব্রিটেন, জার্মানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ চায়নার কয়েকটি ঔষধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান তাদের প্রক্রিয়াজাত ভ্যাকসিনের প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে প্রায় ৯০-৯৫% সফলতা পেয়েছে। সুখবর হচ্ছে, দুইটি ভ্যাকসিন বর্তমানে তাদের শেষধাপে রয়েছে। তবে এদের মধ্যে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে এগিয়ে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের অধীনে চলমান AstraZeneca র (British Pharmaceutical Company) ভ্যাকসিনটি। বিশ্বসাস্থ্য সংস্থার মতে, বর্তমানে ভ্যাকসিনটিকে মানবদেহে পরীক্ষা চালাচ্ছে এবং এর ফলাফল এবছরের সেপ্টেম্বরের মধ্যেই জানা যাবে। ভ্যাকসিন বিষয়ে এক্সপার্ট নই বিধায় (যদি হতামও) এটি বলা প্রায় অসম্ভব যে কোন ভ্যাকসিনটি শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে। হয়তো অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে এ ব্যর্থও হতে পারে, তখন তার ইমিডিয়েট পেছনে থাকা ভ্যাকসিনটি লিড করবে। যদি এটিও সফল না হয় তখন ঠিক তার পরেরটি লিড করবে। এককথায়, At least any of them must take the lead and be succeeded. 


• WB, IDB, NDB,  MIGA মতো পৃথিবীর আর্থ-সামাজিক এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলোর  শত শত প্রকল্প রয়েছে। যেগুলোর কার্যক্রম করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে  স্থগিত রয়েছে। এত বড় বড় প্রতিষ্ঠান গুলো কি তাদের হাজার হাজার কোটি ডলারের এই প্রকল্পগুলো বছরের পর বছর ধরে এভাবেই ফেলে রেখে লোকসান গুনতে থাকবে? কখনোই না !!


• পৃথিবীর কোন দেশই এখন পর্যন্ত শতভাগ অনলাইন ভিত্তিক শিক্ষা-কার্যক্রম চালু করতে পারেনি। যেখানে আমেরিকার মতো উন্নত দেশে মাত্র ৬ মিলিয়ন শিক্ষার্থীদের জন্য অনলাইনভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু করতে পেরেছে যা পৃথিবীর অন্য সব দেশের তুলনায় সর্বোচ্চ। সেখানে এশিয়া-আফ্রিকার অন্যান্য দেশের অবস্থা কেমন হতে পারে তা সহজই অনুমেয়। হ্যাঁ এটা ঠিক যে, সাময়িক এই বিপর্যয়ের কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান স্বল্প পরিসরে অনলাইন ভিত্তিক ক্লাস-এক্সাম চালু করেছে৷ কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এই ব্যবস্থা কতটা কার্যকারী হবে তা নিয়েও যথেষ্ট সংশয় থেকে যায়। 


এমতাবস্থায় কি পৃথিবীর দেশগুলো খুব দ্রুততার সাথে তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে চেষ্টা করবেনা? 


• আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে পর্যটন খাত, যার সূচক গত বছরের শেষ থেকে নিম্নমুখী রয়েছে৷ OECD র এক গবেষণায় উঠে এসেছে যে, ২০২০ সালে আন্তর্জাতিক পর্যটন কমেছে প্রায় ৬০ শতাংশ এবং বছরের শেষ নাগাদ কোন ভ্যাকসিন যদি না আসে তবে তা আরো কমে ৮০ শতাংশে পৌছাবে। ইউরোপ-আমেরিকার বড় বড় দেশের অর্থনীতির বড় একটি উৎস এই পর্যটন শিল্প। দেশগুলো কি একটা লম্বা সময় ধরে এই ক্ষতি বহন করতেই থাকবে? এর সমাধানের লক্ষে কি আপ্রাণ চেষ্টা করবেনা?  


জনসমাজে তৈরি হওয়া আরেকটি অনিশ্চয়তা হলো -- বাংলাদেশ কি ভ্যাকসিন পাবে? যদি পায় তাহলে কি সুষমবন্টন হবে?

পোলিও ভাইরাস সম্পর্কে জানেনা এমন মানুষ খুব কমই পাওয়া যাবে।  কখনো কি শুনেছেন বা দেখেছেন যে ধনীদের অগ্রাধিকার দিয়ে আপনার নিকটস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে পোলিওর টিকা দেয়া হচ্ছে? যদি না হয়ে থাকে তবে এক্ষেত্রেও তেমনটি ভাবার কোন কারণ নেই। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছে যে, ভ্যাকসিন আসা মাত্রই সারা বিশ্বের সকল দেশ তা পাবে এবং এটি তারা নিশ্চিত করবে। তবে যুক্তিসঙ্গতভাবে যারা আগে থেকেই ভ্যাকসিন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান গুলোর সাথে চুক্তি রেখেছে তারা কিছুটা আগে পাবে। কারণ এর পেছনে তাদের মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ জড়িত।  তাইবলে হতাশ হওয়ার কারণ নেই যে, ঠিক সময়ে ভ্যাকসিনটি আমাদের দেশে আসবে না। কারণ এটি ইতোমধ্যেই সবাই উপলব্ধি করেছে যে, ভাইরাস ধর্ম-বর্ণ-জাত-সীমারেখা বুঝেনা। তাই ভাইরাস পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুকনা কেন তা ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগবেনা—পুনরায় এটি অন্তত কোনো দেশ চাইবে না। অতএব নিশ্চিতকরেই বলা যায়,  ভ্যাকসিন আমরাও পাচ্ছি এবং এটি বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ও সরকারের যৌথ সহায়তায় দেশের সর্বস্তরের মানুষের হাতে পৌছাবে। 


ইদানিং জনমনে আরেকটি ভয়ও  তৈরি হয়েছে যে এই ভাইরাসটি পৃথিবী থেকে যাবে না। অনেকেই বিষয়টিকে মাথাব্যাথার কারণ হিসেবে নিয়েছেন। এক্ষেত্রে প্রথম কথা হলো ভাইরাসটি আসলেই থেকে যাবে কিনা তা একমাত্র এর ভ্যাকসিন আসার পরই বুঝা যাবে। কারণ পেলিও, ইনফ্লুয়েঞ্জা, ডেঙ্গুর মতো ভাইরাসগুলো নিয়েই বছরের পর বছর ধরে আমরা স্বাভাবিক জীবন-যাপন করে এসেছি।  এর একটি অন্যতম কারণ হলো এদের ভাল ঔষুধ কিংবা কোন না কোন প্রতিষেধক রয়েছে।  তাই করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন আসার পর এটির অস্তিত্ব পৃথিবীতে যদি থেকেও যায়  তাহলেও মানুষের অভ্যাস কিংবা স্বাভাবিক জীবন-যাপনে এর কোন প্রভাব পড়ার কথা না। তাই আশা করাই যায় পৃথিবী দ্রুতই ঘুরে দাঁড়াবে এবং পূর্বের স্বাভাবিকতায় ফিরে যাবে।


তাই আমাদের উচিত যেকোন তথ্যই যাচাই-বাছাই করে বিশ্বাস করা এবং ঠিক তখনই তা শেয়ার করা। কারণ একটা ভূল তথ্য কিংবা মনগড়া অভিমতই হয়তো আমাদের পাশের  মানুষকটিকে মুহূর্তেই হতাশায় ঠেলে দিতে পারে।  মনোবিজ্ঞানে একটা কথা আছে, “ একজন হতাশব্যাক্তি নিজে নিজের জন্য এবং একইসাথে  সমাজের জন্যও ক্ষতির কারণ হতে পারে। ইতোমধ্যেই  গণমাধ্যমগুলোতে বেড়ে যাওয়া আত্মহত্যা, চুরি-ডাকাতি এবং ধর্ষণের মত ঘটনাগুলো থেকে এর প্রমাণ ও হাতে-নাতে  মিলছে। তাই  সঠিক তথ্য জানা এবং তা অন্যকে জানতে উৎসাহিত করাই পারে আমাদের চারপাশের মানুষকে বাঁচার স্বপ্ন দেখাতে কিংবা তাদের অপরাধ থেকে দূরে সরাতে। 


সেদিন হয়তো খুব দূরে নয়, যেদিন সকালের ঘুমজড়ানো চোখে পত্রিকা হাতে নিয়ে বসব, অক্স্মাৎ একটা শিরোনামে চোখটা আটকে যাবে, বড় বড় অক্ষরে লিখা থাকবে,, "Oxford Vaccine has passed its clinical trial and conforming to the experts it will be available in Bangladesh within the next 2 months". 


পরিশেষে, Hope নিয়ে আমার সবচেয়ে পছন্দের উক্তিটি দিয়ে লিখার ইতি টানছি, "If I have learnt anything in my time travelling the world, it is the power of HOPE, the power of one person; Washington, Lincoln, King, Mandela and even a young girl from Pakistan, Malala. One person can change the world by giving people hope."

_William McRaven, former US Navy Admiral.







No comments:

Post a Comment