Is Murder morally Justifiable??



১৮৮৪ সাল। চারজন ইংরেজ নাবিক সিদ্ধান্ত নিলো যে তারা দক্ষিন আটলান্টিকের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবে। বলে রাখা ভাল, তাদের সাথে যাত্রাসঙ্গী ছিলো আরও একজন- একজন এতিম কেবিন বয়।


ভূখন্ড থেকে যাত্রা শুরুর সময় আকাশে কোন বিপদের লক্ষণ ছিলোনা। তাদের জাহাজ নিরাপদেই মাঝ সমুদ্রের দিকে এগিয়ে যেতে থাকল। অানুমানিক একহাজার কিলোমিটার দূরে আসার পর আটলান্টিকের আকাশ কালো হয়ে ভয়ানক মূর্তি ধারণ করলো। প্রচন্ড ঝড়ে জাহাজটি ডুবে না গেলেও এটি পথ হারিয়ে দক্ষিণে চলে আসলো; জায়গাটি আটলান্টিকের এতই দক্ষিণে ছিলো যে অন্য কোন জাহাজের সাহায্য ছাড়া তাদের বেঁচে থাকাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো, ফিরে যাওয়া কথা বলাই বাহুল্য। 


দেখতে দেখতে ১৫ দিন কেটে গেলো। সাথে যে খাবার ছিলো তাও ফুরিয়ে গেলো। উপোস করে আরো ৩ দিন গেলো। এতদিনেও উদ্ধারকারী কোন জাহাজের হদিস না পেয়ে সবাই প্রায় মানসিক ভাবেও ভেঙ্গে পড়তে শুরু করলো। সেইসাথে ক্ষিদের তীব্রতা তো আছেই। 


এরমধ্যে ঘটে আরেক কান্ড। সকলের নিষেধ উপেক্ষা করে কেবিন বয় সমুদ্রের লবনাক্ত পানি পান করে ফেলে। অল্পক্ষনেই তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে। জাহাজে তখন সবার এমন অবস্থা যে কেবিন বয়ের জন্য সহানুভূতি ছাড়া চার নাবিকের আসলে কিছুই করার ছিলোনা৷ কারণ, শারিরিক ও মানসিকভাবে তারা এতই দুর্বল হয়ে পড়েছিলো যে সবাই ধরেই নিয়েছিলো এভাবেই একজন একজন করেই সবাই মারা যাবে। নাবিকদের মধ্যে জোষ্ঠ নাবিক সবার সাথে আলোচনা করলেন যে কোন সারভাইভালের কোন উপায় আছে কিনা? এবং তিনি এটিও সাজেস্ট করলেন যে কেবিন বয়ের মৃত্যু যেহেতু মোটামুটি নিশ্চিত; তাই তাকে হত্যা করে বাকি চারজন আরও কিছুদিন বেঁচে থাকতে পারে- তার রক্ত-মাংসে ক্ষুধা নিবারণের একটা ব্যবস্থা হতে পারে। খাবারের অভাবে সম্ভাব্য মৃত্যুপথযাত্রী বাকি তিন নাবিকের কাছে এতে সম্মত হওয়া ছাড়া কোন উপায় ছিলোনা।

 

এ বিষয়টি যখন কেবিন বয়কে জানানো হলো তখন তার আর মৃত্যুর মধ্যে দূরত্ব ছিলো মাত্র কয়েক ঘন্টা। লবণাক্ততার তীব্রতায় আসন্ন মৃত্যু জেনে কেবিন বয় বাকি চারজনের এ সিদ্ধান্তে আর বাধা দিতে পারেনি। ফলশ্রুতিতে, কেবিন বয়ের শরীর তাদের খাবারের অভাব সাময়িকভাবে পূরণ করে। ঠিক ১৯ দিনের পর ইউরোপ অভিমুখী একটি জাহাজ তাদের উদ্ধার করে৷

 

ব্রিটেনে ফিরে যাবার পর আদালত তাদের কাছে জানতে চায়, কেবিন বয়কে তারা কিভাবে এবং কোন অবস্থায় হত্যা করে?? তাদের বর্ণনায় প্রথম জজ সন্তুষ্ট হন৷ তিনি মেনে নেন যে এটা অন্যায় নয়, কারণ ভিক্টিমকে হত্যা করা হয়েছে ঠিক; কিন্তু এতে করে বাকি চারজনের জীবন বেঁচে গিয়েছে। অর্থাৎ, তিনি বেনথামের "Greater good for greater number is morally Justified" নীতির মাধ্যমে বিষয়টি জাস্টিফাই করেছেন। সমস্যা বাঁধে যখন আরেকজন জজ সঙ্গে সঙ্গেই প্রথম জজের সিদ্ধান্তে কাউন্টার করে। তিনি বলেন, It's great to get back our four lives alive but Murder is murder-it will never be morally justified." পাল্টাপাল্টি যুক্তিতর্কের পরেও শেষ পর্যন্ত চার নাবিককে জেলে যেতে হয়েছিলো।


গল্পটি যে কমন প্রশ্নটির জন্ম দেয় তা হলোঃ


কেবিন বয়ের শারীরিক অবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই সে মারা যেতো, তাহলে চারজন যদি সম্ভাব্য মৃতদেহ ব্যাবহার করে বেঁচে যেতে পারে তাহলে দোষ কোথায়?? যাদের মাথায় এই লজিকটি এসেছে তারা বেনথামের সাথে একমত হয়েছেন।


কিম্তু স্টুয়ার্ট মিল বলছে, চারজন মানুষের জীবন বেঁচে যাওয়া স্বত্তেও এটি মোরালি জাস্টিফাইড নয়; কারণ এটি পরিষ্কার হত্যাকান্ড- আর হত্যাকান্ড কোন কাজকে মোরাল জাস্টিফিকেশন দিতে পারেনা। স্টুয়ার্ট মিল নিজেও ভোগবাদের পক্ষে ছিলেন কিন্তু তিনি মানুষের ব্যাক্তিস্বাধীনতায় ভায়োলেট করে এমন একশনের ঘোর বিরোধিতা করতেন৷ তিনি বিশ্বাস করতেন, সমাজ যদি হত্যাকান্ড(তা যেকোন কারণেই হোক) মোরালি জাস্টিফাইড করে, তাহলে একটা দীর্ঘ সময়ে পর দেখা যাবে সমাজে খুনোখুনি বেড়ে যাবে আর সব খুনের পেছনে একটা একটা করে যুক্তিও দাঁড়িয়ে যাবে। তখন মোরালিটি বলতে অবশিষ্ট আর কিছু থাকবেনা।

বাংলা বিভক্তি ও গুজবের রাজনীতি


 ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছি পশ্চিমবঙ্গ, আসাম এবং ত্রিপুরা বাংলাদেশের সাথেই ছিলো। ৭১ র পর ভারত আমাদের সহযোগিতা করার বিনিময়ে এ রাজ্যগুলো আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়। 

আসলেই কি তাই??

১৯০৩ সালে লর্ডকার্জনের বঙ্গভঙ্গ করার সময় বাংলা আসাম, উরিষ্যা নিয়ে একটি আলাদা প্রদেশ করার বিবেচনা করা হয়। এর পেছনের কারণ ছিলো তৎকালীন পূর্ববঙ্গ ও আসামের মানুষের নিম্ন মানের জীবনযাত্রা। উপরন্তু, পূর্ববঙ্গের অধিকাংশ মানুষ ছিলো বাংলাভাষী মুসলমান। এতে এ অঞ্চলের প্রতি কলকাতার তৎকালীন হিন্দু ধনিক সম্প্রদায়ের সুনজর তেমনটা ছিলোনা। অর্থনীতি কিংবা রাজনীতি যেকোন কিছুতেই পূর্বাঞ্চলের জনগনকে পশ্চিমবঙ্গের বিশেষ করে কলকাতার উপর নির্ভর করতে হতো। কিন্তু কলকাতার জমিদার সম্প্রদায় ও জাত হিন্দুদের সুনজরে না থাকায় এ অঞ্চলে উন্নয়নের কথা কেউ আমলেই নেয়নি৷ এজন্যই পূর্বাঞ্চলের মানুষের অনেক দিনের দাবি ছিলো তারা আলাদা একটি প্রদেশ গঠন করবে যেন পশ্চিমাঞ্চলের উপর তাদের আর নির্ভর করতে না হয়।

অনেক বিচার-বিবেচনার পর ১৯০৫ সালে যখন বঙ্গভঙ্গ হয় তখন দেখা গেলো সত্যি সত্যি পূর্ববঙ্গ ও আসামের মানুষের জীবনযাত্রায় অভাবনীয় পরিবর্তন লক্ষ করা গেলো। পশ্চিমবঙ্গের অনেক বাঙ্গালীর শিল্পকারখানা এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান  পূর্ববঙ্গে স্থানান্তরিত হয়। আজকাল শতবছরের পুরনো যত স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে তার প্রায় সব বঙ্গভঙ্গের কারণে হয়। তবে এ বঙ্গভঙ্গের ফলাফল পূর্ববঙ্গের জন্য সুফল বয়ে আনলেও এর বিপরীতে কলকাতার মর্যাদা খানিকটা হলেও ম্লান হয়ে পড়ে৷ তাতে অনেক হিন্দু জমিদার, চাকরিজীবী, আইনজীবী এর বিরুদ্ধে সরাসরি কথা বলতে শুরু করে। এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোর বিরোধিতা করে। এজন্যে ব্রিটিশ সরকার ১৯১১ সালে বঙ্গবঙ্গ রধ করে। 

অর্থাৎ এতে স্পষ্ট প্রমাণিত হয়, আসামের সাথে পূর্ববঙ্গ তথা বর্তমান বাংলাদেশর রাজনৈতিক সম্পর্ক টিকেছিলো মাত্র ৬ বছর৷ তাহলে কি মাত্র ৬ বছরের রাজনৈতিক সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে দাবি করা যায় যে আসাম, ত্রিপুরা বাংলাদেশের অংশ ছিলো??

তারপরও একটা সুযোগ ছিলো ১৯৪৭ র শুরুতে। যখন মাউন্টব্যাটেন জিন্নাহকে সোজাসাপ্টা জানিয়ে দেন যে, যদি মুসলিমলীগ ভারত বিভক্তি চায় তাহলে হয় বাংলাকেও ভাঙ্গতে হবে ; নয়তো পাঞ্জাব প্রদেশকে ভাঙ্গতে হবে। তখন প্রত্যাশিতভাবেই জিন্নাহ অখন্ড পাঞ্জাব প্রদেশের স্বার্থে বাংলাকে ভাগ করার কথায় সম্মতি দেয়।

আমি বলছিনা ভারত সরকারের প্রতি মাউন্টব্যাটেন পক্ষপাতিত্ব ছিলেনা। কিন্তু,জিন্নাহ-নেহেরু এ প্রস্তাবে সম্মতি জানানোর পরেই ভারত-পাকিস্তানের সাথে দুই বাংলাও পৃথক হয়ে যায়। 

তাহলে আসাম, ত্রিপুরাকে ৭১ এ ভারত ছিনিয়ে নিয়েছে কিংবা সহযোগিতার প্রতিদানে বাংলাদেশ ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে এ অভিযোগের যৌক্তিকতা কতটুকু??

পদ্মা সেতু ও বাংলাদেশ

 


বিশ্বব্যাংক যখন পদ্মাসেতু নিয়ে বাংলাদেশে ১.২ বিলিয়ন ডলার ঋন দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় তখন সবাই মোটামুটিভাবে ধারণা করেছিলো যে, এত বড় একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন তো শুধুমাত্র সময়ের ব্যাপার !!  

কিন্তু আশ্চার্যজনক হলেও সত্যি, প্রতিশ্রুতির কিছুদিন পরই বিশ্বব্যাংক কানাডার কোম্পানি এসএনসি-লাভালিনের সাথে বাংলাদেশের তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রীর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান "সাকো" র বিরুদ্ধে যোগসাজশের অভিযোগ আনে। এবং দূর্নীতির প্রমাণ পেলে প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়ানোর হুমকি দেয়।

বাংলাদেশ সরকার তৎক্ষনাৎ এ অভিযোগ অস্বীকার করলেও বিশ্বব্যাংকের চাপে দুদককে তদন্তের নির্দেশ দেয়। কিন্তু দুদকের প্রতিবেদনে কোন দূর্নীতি প্রমাণ পাওয়া যায়নি জেনেও বিশ্বব্যাংক এই প্রতিবেদন আমলে না নিয়ে তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্তেই অটল থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। দেশেও গুঞ্জন উঠে দুদক সরকারের চাপে পড়ে সত্য প্রকাশ করছেনা। ফলশ্রুতিতে তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন পদত্যাগ করেন। 

২০১০ থেকে ২০১১ র মাঝামাঝিতে দীর্ঘ ১ বছর ৫ মাস ধরে চলা এ নাটকের শেষ হয় ২০১২ সালে এসে- যখন প্রধানমন্ত্রী দৃঢ়তার সাথে প্রতিশ্রুতি দেন," পদ্মা সেতু অবশ্যই হবে, এবং বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নেই হবে।" শুধু তাই নয়, এতকিছু ঘটার পর সরকার এতটাই সংকল্পবদ্ধ ছিলো যে, বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন না করার নেটিশ পাঠানোর আগেই বাংলাদেশ তাদের জানিয়ে দেয় যে তাদের অর্থায়নে বাংলাদেশ চাচ্ছেনা।

সেসময় এতকিছুর ঘটে যাওয়ার পরও নিজস্ব অর্থায়নে এত বড় একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন বাংলাদেশে সরকারের জন্য ছিলো যেমন চ্যালেন্জিং তেমনি দুঃসাহসিক। তারপরও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অবিচল মানসিকতায় ৩.৬ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে ৬.১৫ কিলোমিটারের স্বপ্নের পদ্মা সেতু আজ দৃশ্যমান। 

সবচেয়ে আনন্দের বিষয় হচ্ছে বিশ্বব্যাংকের মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে সরিয়ে রেখে বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত তা করে দেখাতে পেরেছে। যদিও বিশ্বব্যাংকের ওই অভিযোগ ২০১৭ সালের দিকে এসে কানাডার আদালত এ মামলার রায়ে অভিযুক্তদের নির্দোষ ঘোষণা করে বলেন যে, অভিযোগটি ছিলো মিথ্যা, ইচ্ছা প্রণোদিত এবং সাজানো। 

শুধু পদ্মসেতু কিংবা সমুদ্রসীমা বিজয়ই নয়, স্বাধীনতার অর্জনের পর গত ৪৯ বছরে বাংলাদেশ যা যা কিছু অর্জন করেছে তার প্রত্যেকটি ছিলো আমাদের জন্য একেকটা খন্ড খন্ড বিজয়। হয়তো একাত্তরে যা হারিয়েছি তার ক্ষতিপূরণীয় নয়। কিন্তু বাংলাদেশ যতবার মাথা উঁচু করবে ঠিক ততবার আমাদের মনে হবে, "আমরা পেরেছি, বাংলাদেশ পেরেছে, ১৬ কোটি মানুষের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে।"